বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (বারটান)-এর উদ্যোগে ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ খ্রিঃ নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। বারটান-এর প্রধান কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে এই সেমিনার আয়োজন করা হয়। সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঝরনা বেগম, অতিরিক্ত সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয় ও নির্বাহী পরিচালক, বারটান। উক্ত সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন জনাব এস.এম শিবলী নজির যুগ্মসচিব, কৃষি মন্ত্রণালয় ও প্রকল্প পরিচালক, বারটান এবং জনাব বলাই কৃষ্ণ হাজরা যুগ্মসচিব (গবেষণা), কৃষি মন্ত্রণালয়। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বারটান-এর পরিচালক (যুগ্ম সচিব) কাজী আবুল কালাম। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. এম.এ সালেক, সিনিয়র ম্যানেজার, হারভেস্ট প্লাস বাংলাদেশ।
ড. এম.এ সালেক -এর উপস্থাপিত প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল `Bio-fortification as a strategy for addressing micronutrient deficiencies in Bangladesh’। প্রবন্ধে আলোচিত উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো নিম্নে আলোকপাত করা হলঃ
- বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের খাদ্যাভাসের যে পরিবর্তন হয়েছে তার সম্পূর্ন চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। উল্লেখ যে ১৯৬০ সালে সাধারণ জনগণের খাবারের তালিকায় ভাতের সাথে শুধুমাত্র পেঁয়াজ ও পোঁড়া মরিচ লক্ষ্য করা যেত। কিন্তু পরবর্তিতে কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদনের অমুল পরিবর্তনের ফলে মানুষের খাদ্য তালিকার কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু পুষ্টি বিবেচনায় খাবার তালিকায় কার্বহাইড্রেট-এর পরিমানই বেশি থাকে। সে হিসাবে জনগণ বেশি পরিমাণে ভাত গ্রহণ করে থাকে
- ।Deb and Bayes, 2018 তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে মানুষের মোট খাদ্য শক্তি আসে ৭০% কার্বহাইড্রেট অর্থাৎ ভাত থেকে। সেক্ষেত্রে অন্যান্য খাদ্য উপাদান গ্রহণের প্রবণতা কম থাকায় প্রান্তিক পর্যায়ে পুষ্টির অভাব জনিত সমস্যা (কৃষকায়,খর্বাকৃতি) দেখা যায়। বিশেষ করে আয়োডিন, জিংক, আয়রন ও ভিটামিন এ-এর অভাবজনিত সমস্যার আধিক্য পরিলক্ষিত হয়।
- খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শুধু খাদ্যের প্রাপ্যতা, সহজলভ্যতা ও ক্রয়ক্ষমতাই নয়, পুষ্টিকর খাদ্য ক্রয় এবং গ্রহণের সদিচ্ছাও থাকতে হবে।
- পুষ্টিগত অবস্থার উন্নয়নের জন্য অনুপুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ অপরিহার্য। খাদ্যে এই অনুপুষ্টি সমৃদ্ধকরণে যেসব পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয় সেগুলো হল: Supplementation, Commercial fortification, Dietary diversity, Biofortification | এর মধ্যে Biofortification পদ্ধতিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
- Dr. Howarth Bouis হলেন Biofortification পদ্ধতির জনক | এই পদ্ধতির মাধ্যমেই কম খরচে অধিক ফলন পাওয়া যাবে এবং জনসাধারনের পুষ্টিস্তর উন্নয়ন সম্ভব হবে।
- WFP, 2012 বাংলাদেশের মানচিত্রে যে অপুষ্টির চিত্র তুলে ধরেছেন তাতে অনুপষ্টি -এর অভাব জনিত কারণই বেশি পরিলক্ষিত হয়।
- দৈনিক খাদ্য তালিকায় জিংক এর পরিমাণ কম থাকলেও মানব দেহে এর গুরুত্ব অপরসীম। বর্তমানে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিংক সমৃদ্ধ ধানের ৮টি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে এছাড়াও ৫টি ডাল ও ১টি গমের জিংক সমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।
- গবেষণায় দেখা গেছে, উদ্ভাবিত এই জিংক সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণের ফলে শিশুদের খাদ্য গ্রহণের রুচি বৃদ্ধি পায় এবং অসুস্থতার হারও কমে যায়।
- জিংক সমৃদ্ধ চালের চাহিদা থাকা সতে¦ও বাণিজ্যিক উৎপাদন বৃদ্ধি পায়নি।
- জাতীয় কৃষি নীতি (২০১৮), বাংলাদেশ দ্বিতীয় বিনিয়োগ কর্মপরিকল্পনা (২০১৬-২০) এবং জাতীয় পর্যায়ে অনুপুষ্টির অভাব প্রতিকার ও নিয়ন্ত্রণ কৌশল (২০১৫-২০২৪) নীতিতে Biofortification এর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে |
সেমিনারের আলোচনাঃ
জনাব এস এম শিবলী নজির, যুগ্মসচিব, কৃষি মন্ত্রণালয় ও প্রকল্প পরিচালক, বারটান
- বাংলাদেশের জনগণের পুষ্টিস্তর উন্নয়নের জন্যে মড়াবৎহসবহঃ ধহফ হড়হ-মড়াবৎহসবহঃ সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগে কাজ করতে হবে।
- ভাতের পাশাপাশি রুটির চাহিদাও জনগণের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেক্ষেত্রে গমেরও জিংক সমুদ্ধ জাত উদ্ভাবনে গুরুত্ব বাড়াতে হবে। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, Bio-fortification cost effective analysis আছে কিনা এবং এর Health hazard প্রভাব আছে কিনা?
- বলাই কৃষ্ণ হাজরা যুগ্মসচিব (গবেষণা), কৃষি মন্ত্রণালয়:
- প্রথমে সভার সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন এবং বলেছেন আজকের আলোচনার বিষয়টি অত্যন্ত যুগপোযোগী ছিল।
- বাংলাদেশের জনগণের অপুষ্টির হার কমানোর ক্ষেত্রে জিংক সমৃদ্ধ চালের গুরুত্ব অপরসীম।
- এ যাবৎ ৮টি জিংক সমৃদ্ধ চালের উদ্ভাবন হয়েছে। কিন্তু সঠিকভাবে তা এখনও বাজারজাত করা হয় নাই।
- বাজারে যে ধরনের চালগুলো মানুষের চাহিদার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি (যেমন, ব্রি-২৮, ব্রি-২৯) সেগুলোকে যদি জিংক সমৃদ্ধ করা যায় তাহলে জনগণের মধ্যে জিংকের অভাব জনিত সমস্যা দূরীকরণ করা সম্ভব।
- যেহেতু আমরা ডালে ভাতে বাঙালী সেহেতু ভাতের সাথে জিংক সমৃদ্ধ ডাল বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করা হলে অনেকাংশ জিংকের অভাব দুর হবে।
- আমাদেরকে দারিদ্রপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে জিংক সমৃদ্ধ চাল বিতরণে ও সরবরাহের ব্যবস্থা করলে সবচেয়ে বেশি সুফল পাওয়া সম্ভব।
প্রশ্ন উত্তর পর্ব
প্রবন্ধ উপস্থাপনের পরে সেমিনারে অংশগ্রহণকারীরা প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশগ্রহণ করেন। প্রশ্নোত্তর পর্ব সঞ্চালনা করেন বারটান-এর ঊর্ধ্বতন প্রশিক্ষক ড. মোহাম্মদ রাজু আহমেদ। আলোচনায় অংশগ্রহণকারী সবাই এই ধরণের সেমিনার আয়োজনের জন্য বারটান-কে ধন্যবাদ জানান। রেজাউল করিম, সদস্য, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ জানান, জিংক সমৃদ্ধ শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে কোন নীতিমালা জাতীয় পর্যায়ে গ্রহণ করা হয়েছে কিনা এবং এর আইনগত বৈধতা আছে কিনা সে ব্যাপারে তিনি দৃষ্টিপাত করেন। ড: মোহাম্মদ সিদ্দিকী, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI) বলেছেন, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে Bio-fortification -এর মাধ্যমে যে জিংক সমৃদ্ধ ধান উদ্ভাবন করা হয়েছে তার Health Hazard সহনীয় করেই অবমুক্তি করা হয়েছে। Dr Caraig Meisner, FAO বলেছেন, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে কৃষি মন্ত্রণালয়ে এক সাথে কাজ করলে জনগণের অনেকাংশ পুষ্টি উন্নয়ন সম্ভব। তাছাড়া আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে গুদামজাতের ফলে পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ নষ্ট হয় কিনা। আবু নোমান ফারুক, সহযোগী অধ্যাপক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় মতামতে উল্লেখ করেন যে, ধানের Bio-fortification -এর সাথে আলুর Bio-fortification ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ জনগণ দৈনিক খাদ্য তালিকায় আলু বিভিন্ন ভাবে গ্রহন করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যঃ
সেমিনারের প্রধান অতিথি জনাব ঝরনা বেগম, অতিরিক্ত সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয় ও নির্বাহী পরিচালক, বারটান খাদ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি পুষ্টি ও নিরাপত্তার প্রতি জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, জনগণের পুষ্টিস্তর উন্নয়নের লক্ষ্যে বারটান কাজ করে চলছে। এর ধারাবাহিকতায় আজকের এই সেমিনার আয়োজন করা হয়েছে। তিনি প্রথমত গুরূত্বরোপ করেছেন Bio-fortified খাদ্যগুলি যেন আমাদের হাওর ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। আর তিনি উল্লেক্ষ করেন জনগনের পুষ্টির স্তর উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সকল সংস্থা একসাথে কাজ করতে হবে।
সেমিনার থেকে নিন্মোক্ত পরামর্শ সমূহ পাওয়া যায়:
- Bio-fortification পদ্ধতিতে উৎপন্ন বিভিন্ন শস্যের সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য Marketing channel তৈরি করতে হবে।
- প্রান্তিক পর্যায়ে এর সরবরাহ বৃদ্ধি ও নিশ্চিত করতে হবে।
- Bio-fortification -এর পদ্ধতির সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
- আবার শুধুমাত্র আইন বা নীতিমালা করে পুষ্টি নিশ্চিত করা সম্ভব না, এক্ষেত্রে সবার সচেতনতাও জরুরি।
- খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
- নিয়মিতভাবে এবং বড় পরিসরে এই ধরনের সেমিনার আয়োজন করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্য:
সভাপতির বক্তব্যে বারটান এর সম্মানিত পরিচালক জনাব কাজী আবুল কালাম সেমিনারে সময় উপযোগী বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে সবাইকে ধন্যবাদ দেন। তিনি বলেন প্রশ্ন করার মাধ্যমে সবার জ্ঞানের স্তর উন্নত হয়েছে। তিনি সেমিনিারে অংশগ্রহনকারী সবাইকে অর্জিত জ্ঞান সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার আহবান জানান। তিনি বিশেষ করে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এর সদস্যকে সেমিনারে উপস্থিত থাকার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন, জিংক এর চাহিদার উপর ভিত্তি করে এলাকা চিহ্নিত করতে হবে এবং শহরের জন্য এর দরকার আছে কি না তাও চিহ্নিত করতে হবে আর দরকার হলে তা বিবেচনায় আনা দরকার। তিনি সর্বশেষে সম্মানিত প্রবন্ধ উপস্থাপককে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানিয়ে সেমিনারের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।